সাদা মনের এক মানুষ
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
❑
আমরা পাঁচ ভাই দুই বোন।বড়
ভাইয়ের বয়স এখন ৮৪ বছর।সরকারি চাকুরী থেকে অবসর নেয়ার পর থেকেই তিনি ফেনী, জিএমহাট,
নুরপুর গ্রামে আছেন।মেজো ভাই মহিউদ্দিন আহমদ যাঁকে নিয়ে আমার আজকের কলাম, তিনি পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন এবং অবসর নেন সম্ভবত ২০০১ সনের জানুয়ারি মাসে।চাকুরী ও পদমর্যাদা
আকর্ষণীয় হলেও তিনি কখনো আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিলেন না।কারণ চাকুরীর শুরু থেকেই তাঁকে
পিতার সংসার ও ভাই-বোনদের পড়ার খরচ যোগাতে হয়েছে।অবশ্য এই খরচে তাঁর আনন্দ ছিলো।আমাদের
বাবা ছিলেন গ্রামের একটি মাইনর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক, তাঁর পক্ষে সব খরচ বহন
করা সম্ভব ছিলো না।মহিউদ্দিন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স করে
ইন্টারউইং স্কলারশীপ নিয়ে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন।১৯৬৫ সনে মাস্টার্স
শেষ করেই তিনি রেডিও পাকিস্তান করাচিতে অনুবাদকের চাকুরী নেন।কিছুদিন পর রেডিও পাকিস্তানের
চাকুরী ছেড়ে দিয়ে তিনি দেশে এসে ফেনী কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।এই কলেজ থেকেই তিনি
পাকিস্তান সুপারিয়র সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে ১৯৬৭ সনে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন,
প্রশিক্ষণ শেষে তাঁর প্রথম পোস্টিং হয় লণ্ডনে পাকিস্তান দূতাবাসে।
একাত্তরের পহেলা আগস্টে তিনি
পাকিস্তান দূতাবাস ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেন।মুক্তিযদ্ধের শুরুতেই
তিনি বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন।কিন্তু বিচারপতি আবু
সাইদ চৌধুরীর অভিমত ছিলো, আনুগত্য স্বীকারের সময় তখনো হয়নি।ফলে তাঁকে আগস্ট মাস পর্যন্ত
বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর সবুজ সঙ্কেতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে।তবুও ইউরোপে তিনিই
প্রথম বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেন।লণ্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে হাজার হাজার
বাঙ্গালীর মুহুর্মুহু শ্লোগানের ভেতর মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য
প্রকাশ করেন।তাঁর আনুগত্য ঘোষণার এই উৎসবমুখর ঘটনার মনোরম বর্ণনা রয়েছে সুনীল গঙ্গাপাধ্যায়ের
‘পূর্ব পশ্চিম’ উপন্যাসে।পাকিস্তান দূতাবাসের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে কোথায় কিভাবে থাকবেন,
কিভাবে খাবেন তা তাঁর মাথায় ছিলো না, মাথায় ছিলো শুধু মুক্তিযুদ্ধ।সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকে
নিয়ে তাঁর মাথা গোঁজার কোন ঠাঁই ছিলো না, হাতে টাকা ছিলো না, কিন্তু এই সকল সমস্যা
তাঁকে আনুগত্যের ঘোষণা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।কারণ তিনি পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি
ছিলেন ক্ষুব্ধ, করাচিতে পড়াশুনা করতে গিয়ে তিনি বাঙ্গালীদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের
বন্ছনা ও শোষণের প্রকৃত চিত্র দেখতে পেয়েছিলেন।এছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সলিমুল্লাহ হলে সক্রিয়ভাবে ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।
বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর
তত্ত্বাবধানে তিনি লণ্ডনে বসে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কাজ করতে থাকেন।যাদের আত্মীয়-স্বজন
তখন পশ্চিম পাকিস্তানে থাকতেন তারা জানেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের বাঙ্গালীরা লণ্ডনের
মাধ্যমে দেশে চিঠিপত্র পাঠাতেন, আমার এই মেজো ভাইই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাওয়া চিঠিপত্র
বাংলাদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করতেন।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনিই আবার ১৯৭৩ সনে পশ্চিম
পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত বাঙ্গালীদের দিল্লী বিমানবন্দরে রিসিভ করে বাংলাদেশে পাঠানোর
ব্যবস্থা করেন।এই বিমানবন্দরে তিনি পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত রিয়াজ রহমানকে পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের আক্রোশ থেকে রক্ষা করেছিলেন; অথচ রিয়াজ রহমান
পররাষ্ট্র সচিব থাকাকালীনই আমার এই মেজো ভাই চাকুরীচ্যুত হন। পাকিস্তানের প্রতি অনুগত
রিয়াজ রহমান পরবর্তীতে বিএনপি আমলে পররাষ্ট্র সচিব এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন।
বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মহিউদ্দিন আহমদকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অস্থায়ী
প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করা হয়।খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই বিএনপি’র একদল
সাংসদ নিউইয়র্কে সরকারি সফরে যান, তাদের মধ্যে নোয়াখালীর জিয়াউল হক জিয়াও ছিলেন।তিনি
মেজো ভাইয়ের অফিসে গিয়ে দুটি ছবি দেখে ঢাকায় এসে বিএনপি সরকারের কাছে নালিশ করেন; নূর
হোসেনের বুক-পিঠে লেখা সেই বিখ্যাত ছবিসহ বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের পাশে শেখ হাসিনা ও
খালেদা জিয়ার গোমটা টানার অপরূপ দৃশ্য সম্বলিত ঐতিহাসিক ছবিটি তাঁর অফিস কক্ষে টাঙ্গানো
ছিলো।এই দুটি ছবি রাখার অপরাধে চাকুরীর পঁচিশ বছর পূর্তিতে বিএনপি সরকার তাঁকে চাকুরী
থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেয়; তিনি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন।পরবর্তীতে ১৯৯৬ সনে
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মামলা প্রত্যাহার করার শর্তে তাঁকে চাকুরীতে পুনর্বহাল করা
হয়।
তিনি মুক্তিযোদ্ধা চাকুরিজীবী
হিসেবে সরকার প্রদত্ত দুই বছরের এন্টিডেইটেড সুবিধা গ্রহণ করেননি, এমন কি তিনি বহু
বছর মুক্তিযোদ্ধা সনদ এবং ভাতাও নেননি।মাত্র দুই/তিন বছর পূর্বে তিনি মুক্তিযোদ্ধার
সনদ নিয়ে ভাতা গ্রহণ শুরু করন।ভাতা গ্রহণের ব্যাপারে বন্ধুদের পরামর্শ ছিলো, এই অল্প
সন্মানী সরকারকে দিয়ে দিলে সরকারের কোন উপকার হবে না, এই টাকা নিয়ে বরং তাঁর পছন্দানুযায়ী
গরীবদের দেয়া হলে তারা উপকৃত হবে; তারা জানতেন, তাদের এই বন্ধুটি সম্পদশালী না হলেও
গরীব ও অসহায়দের সম্পদ বিলাতে অকৃপণ।তাঁর গাড়ি নেই, অতিরিক্ত সম্পদ নেই; অবসর গ্রহণের
পর তিনি পাবলিক বাসে যাতায়াত করতেন।এখন বয়সের কারণে আর বাসে চড়তে পারেন না, তাঁর বন্ধু
সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম বেদুর গাড়ি দিয়ে বা উবারে চলাফেরা করেন।পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলেও
তিনি গ্রামের গরীব ও তাঁর বাল্যকালের ঘনিষ্ঠতম নি:স্ব বন্ধুদের প্রতিমাসে অর্থ সাহায্য
করে যাচ্ছেন; মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাওয়ার পর থেকে অর্থ গ্রহনেচ্ছু বন্ধুদের নিয়ে তাঁর
প্রণীত তালিকা বড় হয়েছে।এছাড়াও তিনি ধর্ষিতা, নির্যাতিত গৃহকর্মী, আগুনে পোড়া ও
দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় ও নি:স্বদেরও নিয়মিত অর্থ সহায়তা করে থাকেন।তাঁর জমা অর্থের
কিছু আমাকে নমিনি করেছেন যাতে উক্ত টাকার লভ্যাংশসহ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তাঁর করা তালিকা
অনুযায়ী তাঁর অবর্তমানে বিলি করতে পারি।
মেজো ভাই শিশুদের খুব পছন্দ
করেন, তাঁর বাসায় তিনি ললিপপ, চকোলেট জমা রাখেন- কোন শিশু তাঁর বাসায় গেলেই এগুলো দেন।তিনি
রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ভালবাসেন, বিবিসি শোনা কখনো বাদ যায় না, বিবিসি শোনার সময় কেউ
ফোনে বা অন্য কোনভাবে ডিসটার্ব করলে তিনি বিরক্ত হন।জাতির উদ্দেশ্যে আইয়ুব খানের ভাষণ
শোনার জন্য তিনি আমাকে নিয়ে গ্রামের বাজারে ডা. সতীশ দাদার চেম্বারে চলে যেতেন।তিনি
মঞ্চ-নাটকের ভক্ত; স্বাধীনতার পর ত্রিশ/চল্লিশ জন নিয়ে তিনি মঞ্চ-নাটক দেখতেন; এত লোক
নিয়ে নাটক দেখার দুটি উদ্দেশ্য- নাটককে প্রমোট করা এবং নাটকের প্রতি ছোটদের আগ্রহী
করে তোলা।তিনি বইমেলা থেকেও প্রচুর বই কিনেন, তাঁর অনেকগুলো বুকশেলফ রয়েছে।পরিবারের
ছোটদের তিনি বইমেলা থেকে বই কেনার জন্য টাকা দেন।তিনি প্রচুর পড়েন; তিনি ঘুমানো ছাড়া
বাকী সময় পত্রিকা, ম্যাগাজিন পড়ে সময় কাটান।
আমাদের এই মেজো ভাই এক সময়
তাঁর বাড়ীর বিস্তৃত লনে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে নিয়মিত আড্ডা
ও গানের আসর বসাতেন; এই আসরে যারা থাকতেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন সাংবাদিক
ওবায়েদ উল হক, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, সাংবাদিক বজলুর রহমান, সাংবাদিক এ বি এম মুসা,
ইসলামিক ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী,
ড. আনিসুজ্জমান, কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ আবুল মকসুদ, আবুল মাল আবদুল মুহিত, আবদুল
গাফফার, মতিয়া চৌধুরী, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ড. আকবর আলী, মাসুদা ভাট্টি, ধীরেন্দ্রনাথ
দত্তের নাতনি অ্যারমা দত্ত, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গিটারিস্ট
এনামুল কবির, ডা: দীপু মনি, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, মেজর জেনারেল (অব.)
কে এম শফিউল্লাহ বীরউত্তম, কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীর বিক্রম, মেজর (অবঃ) হাফিজ উদ্দিন
আহমেদ বীরবিক্রম প্রমুখ।আমার উল্লেখিত ব্যক্তিদের মধ্যে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচমেটদের
নাম নেই; তবে সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম বেদু, সাবেক সচিব আব্দুল মতিন, শরবিন্দু শেখর চাকমা
এবং তাঁর ফেনী কলেজ-ছাত্র গেদুচাচা খ্যাত সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা খোন্দকার মোজাম্মেল
হকের নাম উল্লেখ করতে হয়।এই অনুষ্ঠানে ১৯২৭ সনে জন্ম নেয়া ইসলাম বিষয়ে পণ্ডিত ও কলাম
লেখক সা’দ উল্লাহ সাহেব যখন ‘ভুবনেশ্বর হে, মোচন কর বন্ধন সব মোচন কর হে’ অথবা তুমি
কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা’ রবি ঠাকুরের গান কণ্ঠে তুলতেন তখন সবার কণ্ঠ থেমে যেত।মেজো
ভাইয়ের স্ত্রী বিলকিস মহিউদ্দিন এবং আমার মেয়ে সানজানা ফারিয়াল ঐশীর গানও থাকতো এই
সকল অনুষ্ঠানে।
মেজো ভাই দেশের উল্লেখযোগ্য
দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রায় পনের শত কলাম লিখেছেন।দৈনিক সংবাদের সাথে তাঁর রয়েছে
আত্মিক সম্পর্ক; বজলুর রহমান সাহেব থাকতে তিনি নিয়মিত সংবাদে কলাম লিখতেন।তাঁর কলাম
খুব জনপ্রিয় ছিলো।তাঁর দুটি অহঙ্কার আছে- এক, মুক্তিযোদ্ধা হিসেব পরিচয় দিতে তিনি অহঙ্কারবোধ
করেন; দুই, তিনি অহঙ্কার করেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে।পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সনের ৮ জানুয়ারি লণ্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করলে তাঁকে অভ্যর্থনা
জানানোর বিরল সুযোগ পেয়েছিলেন আমার এই ভাই।মৃত্যুর কোল থেকে ফেরত আসা বঙ্গবন্ধুকে
দেখে মেজো ভাই আবেগায়িত হয়ে উঠলে, বঙ্গবন্ধু তাঁকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেছিলেন, ‘ভয়
নেই, আমি এসে গেছি’।বাঙ্গালীর ইতিহাসের অংশ পুরাপুরি অসম্প্রদায়িক জনাব মহিউদ্দিন আহমদ
চলতি মাসের ১৯ জুনে আশি বছর বয়সে পদার্পন করেছেন।তাঁর জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ
।
❑
লেখক
বাংলাদেশ ব্যাংকের
সাবেক নির্বাহী পরিচালক
ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং
কর্পোরেশনের
সাবেক ব্যবস্থাপনা
পরিচালক
ahmedzeauddin0@gmail.com