মানিকগঞ্জ জেলার নামকরণ ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ
মানিকগঞ্জ, নাম শুনলেই মানিক কথাটা মাথায় আসে। শত মানিকের জেলা
মানিকগঞ্জ। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রে জাতীয় এবং
আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে সমুজ্জল মানিকগঞ্জের মানিকেরা। সংস্কৃত ‘মাণিক্য’ শব্দ থেকে
মানিক শব্দটি এসেছে। মাণিক্য ও মানিক সমার্থবোধক শব্দ। মাণিক অথ চুণি, পদ্মরাগ,
মণি কিংবা মুক্তা। মাণিকের ইংরেজি ৎঁনু বা লববিষ। মানিক শব্দটি মাণিকের তদ্ভব রূপ।
‘গঞ্জ’ শব্দটি ফার্সি যার অর্থ হাট, বাজার বা শস্যাদি ক্রয় বিক্রয়ের স্থান।
সুলতানী আমল থেকে শুরু করে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ফার্সি ছিল এ অঞ্চলের রাষ্ট্রভাষা।
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ইংরেজি প্রচলিত হওয়ার পরও দীর্ঘদিন স্কুল কলেজে ফার্সি পড়ানো
হতো। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক আরবি ফার্সি শব্দ বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়ে। ‘গঞ্জ’ শব্দটি
এভাবেই আমাদের ভাষায় স্থান করে নেয়। ‘মনিকগঞ্জ’ নামকরণটি কখন হয়েছিল, সে সম্পর্কে
স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কষ্টকর।
মানিকগঞ্জ নামের উৎপত্তি সম্পর্কিত ইতিহাস এখনও রহস্যাবৃত। স্থানীয় জনশ্রুতিই এর
একমাত্র ঐতিহাসিক উৎস এবং তা বিতর্কিত। ‘মনিকগঞ্জ’ নামে কোনো গ্রাম, মৌজা বা
পরগনার অস্তিত্ব নেই। ১৯৪৫ সাল থেকে ‘মানিকগঞ্জ’ নামের উদ্ভব দেখা যায়। এর পূর্বের
কোন ঐতিহাসিক বিবরণে, মানচিত্রে বা সরকারি নথির-পত্রে ‘মানিকগঞ্জ’ নামের উল্লেখ
পরিলক্ষিত হয় না।
স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী মানিকগঞ্জ জেলার ইতিহাসে বর্ণিত আছে যে, বহু অলি আউলিয়ার পূণ্যভূমি ধামরাই থেকে জনৈক
দরবেশের নির্দেশক্রমে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে মানিক শাহ নামক এক সুফি দরবেশ
সিংগাইর উপজেলার ‘মানিকনগর’ গ্রামে আগমন করেন এবং খানকা প্রতিষ্ঠা করে ইসলাম ধর্ম
প্রচার করেন। পরবর্তীকালে তিনি এ খানকা ছেড়ে হরিরামপুর উপজেলায় দরবেশ হায়দার শেখ
এর মাজারে গমন করেন এবং ইছামতির তীরবর্তী জনশূন্য চরাভূমি বর্তমান মানিকনগরে এসে
খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। এ খানকাকে কেন্দ্র করে এখানে জনবসতি গড়ে উঠে। উক্ত জনজসতি
মানিক শাহ’র পূণ্য স্মৃতি ধারণ করে হয়েছে ‘মানিকনগর’। মানিক শাহ ্ শেষ জীবনে
ধামরাইতে অবস্থিত আধ্যাত্মিক গুরুর দরবার শরিফে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পুনরায় দ্বিতীয়
খানকা ছেড়ে ধলেশ্বরীর তীরে পৌঁছেন। জায়গাটির নৈসর্গিক দৃশ্য তাঁর পছন্দ হয়। তিনি
এখানে খানকা স্থাপন করেন। প্রথম ও দ্বিতীয় খানকার ভক্তবৃন্দও এখানে এসে দীক্ষা
নিত। মানিক শাহর অলৌকিক গুণবালীর জন্য জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা
করতো। এমনকি দস্যু তষ্করগণও কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে খানকার ধারে কাছে আসতো না। তাই
ভক্তবৃন্দ ছাড়াও বণিকগণও এখানে বিশ্রাম নিতো এবং রাত্রি যাপন করতো। সওদাগরী
নৌকাগুলো নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে খানকার তীরে নোঙর ফেলে রাত্রি কাটাত। এভাবেই
ধলেশ্বরীর তীরে মানিক শাহ’র খানকাকে কেন্দ্র করে জনবসিত মোকাম প্রতিষ্ঠিত হয়।
মানিক শাহ এক রাতে সোনারগাঁওয়ের পথে উধাও হয়ে যান। মানিক শাহ চলে গেলেও তাঁর খানকা
এবং তৎসংলগ্ন মোকাম বা গঞ্জ পরবর্তীকালে তাঁর নামানুসারেই ‘মানিকগঞ্জ’ হয় বলে
ধারণা করা হয়। উক্ত খানকা তৎ সংলগ্ন গঞ্জ নদীতে বিলীন হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও ১৮৪৫
সালে সম্ভবত এ সুফি দরবেশের নামানুসারেই মানিকগঞ্জ মহকুমার নামকরণ করা হয়ে থাকতে
পারে।
মহকুমা ঘোষণা:
ইংরেজ শাসক কর্তৃক ১৮৪৫ সালের মে মাসে মানিকগঞ্জ মহকুমা প্রতিষ্ঠিত
হয়। মানিকগঞ্জ মহকুমা প্রথমে ১৮১১ সালে সৃষ্ট ফরিদপুর জেলার অধীনে ছিল এবং
প্রশাসনিক জটিলতা নিরসনকল্পে ১৮৫৬ সালে মানিকগঞ্জ মহকুমাকে ফরিদপুর জেলা থেকে কেটে
ঢাকা জেলার অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে মানিকগঞ্জ মহকুমা প্রতিষ্ঠার লগ্নে তিনটি রাজস্ব
থানায় বিভক্ত উনিশ শতকের শেষ দিকে জাফরগঞ্জ থানার সদর টাউনসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকা
নদী গর্ভে বিলুপ্তি হয়ে গেলে এবং উক্ত ভাঙন অব্যাহত থাকলে জাফরগঞ্জ থানা সদর
শিয়ালোতে স্থানান্তরিত করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে জাফরগঞ্জের পরিবর্তে থানা সদর
‘শিয়ালো’ নামেই পরিচিত হয়। অন্যদিকে কয়েক শতাব্দীর প্রাচীন ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত
বিখ্যাত জাফরগঞ্জ ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়ে প্রবেশ করে।
বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক
প্রয়োজনেই বৃহৎ মানিকগঞ্জ ও শিয়ালো রাজস্ব থানা ভেঙে অতিরিক্ত চারটি নতুন থানার
সৃষ্টি করে। ফলে থানার সংখ্যা বেড়ে সাতে উন্নীত হয়। থানাগুলো হলো:
১. মানিকগঞ্জ, ২. সাটুরিয়া, ৩. সিংগাইর, ৪. শিবালয়, ৫. ঘিওর, ৬. দৌলতপুর
এবং ৭. হরিরামপুর।
১৮৪৭ সালে ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকের অবসান ঘটে এবং ১৪ই আগষ্ট
পাকিস্তান এবং ১৫ই আগষ্ট ভারত নামে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয়
ঘটে। মানিকগঞ্জ তৎকালীন পূর্ব বাংলা পরে পূর্ব পাকিস্তানের একটি মহকুমায় পরিণত হয়।
জেলা ঘোষণা:
তিরিশ লক্ষ লোকের প্রাণহানী ও দু’লক্ষ নারীর সম্ভবহানীর পর এক
ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ
স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৮৪ সালে এরশাদের সামরিক সরকার দেশের প্রশাসনিক
পূনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে সিদ্ধান্তের আলোকে সকল
মহকুমাকে জেলায় এবং থানাগুলোকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। মানিকগঞ্জ বাংলাদেশের জেলা
হিসেবে গণ্য হয় ১৯৮৪ সালে ১লা মার্চ থেকে।
ভৌগলিক অবস্থান:
মানিকগঞ্জ বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্ত ঢাকা বিভাগের একটি জেলা। এই
জেলার উত্তর সীমান্তে টাংগাইল জেলা; পশ্চিম, পশ্চিম-দক্ষিণ এবং দক্ষিণ সীমান্তে
যমুনা এবং পদ্মা নদী যথাক্রমে পাবনা ও ফরিদপুর জেলাকে বিচ্ছিন্ন করেছে। পূর্ব,
উত্তর-পূর্ব এবং পূর্ব-দক্ষিণে রয়েছে ঢাকা জেলার যথাক্রমে ধামরাই, সাভার,
কেরানীগঞ্জ, দোহার এবং নবাবগঞ্জ উপজেলা।
মানিকগঞ্জ জেলার আয়তন ১৩৭৮.৯৯ বর্গ কিঃমিঃ। জনসংখ্যা ১২,৭৮,৮২৯ জন।
জনবসতির ঘনত্ব ৮৩৫ প্রতি বর্গ কিমি। এখানকার গড় সর্বোাচ্চ তাপমাত্রা ৩৮০ সে. এবং
সর্বনিম্ম ১২.৭০ সে.। বার্ষিক বৃষ্টিপাত ২৩৭৬ মিমি.।
মানিকগঞ্জ জেলা সর্বমোট ৬৬টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। জেলা শহর ৯টি ওয়ার্ড
ও ৪৯টি মহল্লা নিয়ে গঠিত।
বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত এ অঞ্চলে জলপথই ছিল যোগাযোগ
ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। প্রবহমান অসংখ্য নদ-নদী ও খাল-বিল ভূ-খন্ডকে জালের মতো
সংযুক্ত করে রাখায় জলপথই ছিল যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। প্রবাহমান জলধারার উভয়
পার্শ্বে জনবসতি গড়ে ওঠে। ঢাকা থেকে সড়ক পথে দূরত্ব ৬৮ কি.মি।
মানিকগঞ্জ জেলা রাজধানী ঢাকার অতি নিকটে অথচ মানিকগঞ্জ জেলা
বাংলাদেশের একটি উন্নয়ন -বঞ্চিত জেলা। মানিকগঞ্জ জেলার উন্নয়নে এ জেলার মানুষ
বর্তমান সরকারের চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় সকল বিষয়ে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির
বাস্তবায়ন দেখতে অপেক্ষমান ।
তথ্যসূত্র: বাংলা একাডেমি প্রকাশিত “বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি
গ্রন্থমালা” মানিকগঞ্জ।