ইসরাইলে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং আমাদের ভাবনা ❑ জিয়াউদ্দীন আহমেদ

0

ইসরাইলে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং আমাদের ভাবনা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

মেশিন রিডেবল পাসপোর্টে নিষেধাজ্ঞার কথা লেখা থাকলেও সম্প্রতি নতুন ছাপানো ই-পাসপোর্টে ‘ইসরাইল ছাড়া সব দেশ’ এই কথাটি বাদ দেয়া হয়েছে।নতুন পাসপোর্ট ব্যাপকভাবে এখনো ইস্যু না হওয়ায় বিষয়টি অনেকের নজর এড়িয়ে গেছে।হামাসের সাথে ইসরাইলের সম্প্রতি লড়াই না বাঁধলে সম্ভবত কেউ বিষয়টি নিয়ে মাথাও ঘামাত না।এই বাদ দেয়ার খবরটি জনগণ জানতে পারে ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারো একটা টুইট-বার্তা থেকে।ইসরাইল বাংলাদেশের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে।কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশি পাসপোর্টে ইসরাইল ভ্রমণে আগের মতোই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে।ইসরাইলের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই; বাংলাদেশ ইসরাইলকে স্বীকারও করে না।অপরদিকে জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে মাহমুদ আব্বাস নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিন সরকারকে বাংলাদেশ স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ঢাকায় তাদের দূতাবাসও রয়েছে।এছাড়াও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পাসপোর্টের গুরুত্বও কম।অনেক দেশের পাসপোর্টে বিনা ভিসায় শতাধিক দেশ ভ্রমণ করা যায়।আমাদের পাসপোর্টে ভিসা থাকার পরও বিভিন্ন দেশের ইমিগ্রেশনে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।পৃথিবীর অনেক দেশের ইমিগ্রেশনে ইহুদিরা চাকুরী করেন, তারা যখন দেখে আমাদের পাসপোর্টে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কিছু লেখা আছে তখন ঐ ইমিগ্রেশন-অফিসার বাংলাদেশী যাত্রীর প্রতি সদয় থাকে না।এছাড়াও যে দেশকে বাংলাদেশ স্বীকারই করে না সেই দেশের কথা পাসপোর্টে লিখে রাখা অর্থহীন ও বোকামি।

ইসরাইলের সাথে সম্পর্কের প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম জগতে একটা নতুন চিন্তা-ভাবনার উন্মেষ ঘটেছে।মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি আরব দেশ ইসরাইলের সঙ্গে তাদের বৈরি অবস্থানের অবসায়ন চায়।মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর কয়েকটির ক্ষেত্রে এমন পরিবর্তন এলেও পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এখনো অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রই দেখে থাকে।কিন্তু এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব হবে যখন ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা অনুমোদন করবে।কারণ তেয়াত্তর বছর ধরে ইসরাইলের অস্তিত্ব অস্বীকার করেও কোন লাভ হয়নি; যতবারই ইসরাইলের সাথে ফিলিস্তিন ও মুসলিম দেশগুলো লড়তে গেছে ততবারই ভূমি হারিয়েছে।এই অবস্থায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার দূতিয়ালি করে কিছু দেশকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছে যে, এভাবে ইসরাইলের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কখনো সম্ভব হবে না, বরং ইসরাইলকে মেনে নিয়েই মুসলিম দেশগুলোকে এগুতে হবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মরক্কো, সুদান ও বাহরাইন সম্প্রতি ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে।অবশ্য ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পরপরই মুসলিম দেশ তুরস্কের সাথে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।১৯৪৮ সনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক বছর পরই তুরস্ক ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়।ইসরাইলে রপ্তানিকারক শীর্ষ ১০ দেশের একটি তুরস্ক; অথচ ইসরাইলের বিরুদ্ধে এখন বেশী সোচ্চার তুরস্ক, বিষয়টি মনে হয় রাজনৈতিক।আরব বিশ্বে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং নিজ দেশে ইসলামপন্থীদের দলে টেনে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর লক্ষ্যে এরদোয়ান সাম্প্রতিক সময়ে ঘোর ইসরাইল বিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। জর্ডান ও মিশরের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক বহু বছর আগে থেকেই।১৯৭৩ সনের যুদ্ধে ইসরাইলকে কাবু করতে ব্যর্থ হয়ে মিশর ক্যাম্পডেভিট চুক্তি করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৭৯ সনে ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে।জর্ডান এই সম্পর্ক স্থাপন করে ১৯৯৪ সনে।আরব লীগের সদস্য মৌরিতানিয়া ১৯৯৯ সনে ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করলেও ২০১০ সনে আবার সম্পর্কচ্ছেদ করে।সৌদি আরবের সাথে ইসরাইলের একটি গোপন আঁতাত গড়ে উঠার কথা সবাই বিশ্বাস করে।ভেতরে ভেতরে যত যোগাযোগই থাকুক না কেন, ইসরাইলকে এক্ষুণি স্বীকৃতি দিয়ে মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার মোড়লগিরির পদ হারাতে চাইবে না সৌদি আরব।

সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের শেখ হামাদ ৯২ মিলিয়ন ডলার বা ৭৮০ কোটি টাকা দিয়ে ‘বেইতার জেরুজালেম’ নামের একটি ইসরাইলি ফুটবল ক্লাবের অর্ধেক শেয়ার কিনে নিয়েছেন।ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামেন নেতানিয়াহু এই ক্লাবটির সমর্থক, আর এই ক্লাবের উগ্র সমর্থকগোষ্ঠী আরবদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে।মুসলমান বিদ্বেষী এমন একটি ফুটবল ক্লাব ক্রয় করার পরও সংযুক্ত আরব আমিরাতের জনগণের কোন উচ্চবাচ্য নেই।ভারত দীর্ঘদিন ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরাইলের বিপক্ষে ছিলো এবং এই কারণেই ভারতের সাথে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিলো না, সম্প্রতি মোদি সরকার সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।এই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের কারণে ভারতের সাথে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর সম্পর্কের সামান্যতম অবনতিও হয়নি।অবশ্য স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইলে বরং মুসলিম দেশগুলো একঘরে হয়ে যাবে।কারণ জাতিসংঘের ১৯৩ দেশের মধ্যে ১৬৪টি দেশ ইতোমধ্যে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ইসরাইল প্যালেস্টাইন অঞ্চলে যা হচ্ছে তেমন ঘটনা পৃথিবীর আরো নানা প্রান্তেও হচ্ছে। ফিলিস্তিনের জনগণের উপর ইসরাইলের নির্যাতনের জন্য কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখা না গেলে একই যুক্তিতে বাংলাদেশর উচিত কাশ্মীরের জনগণের দুর্দশার কথা ভেবে ভারতের সাথে, বেলুচিস্তানের জনগণের কথা ভেবে পাকিস্তানের সাথে, কুর্দি জনগণের প্রতি দয়ার্দ হয়ে ইরাক, সিরিয়া, তুরস্কের সাথে, রোহিঙ্গাদের সমর্থনে মিয়ানমারের সাথে, উইঘুর জনগোষ্ঠীর পাশে থেকে চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা।এমন নির্যাতন পৃথিবীর নানা প্রান্তে আরও হচ্ছে, এখানে শুধু মুসলমান জাতিগুলো থেকেই কয়েকটি উদাহরণ নিলাম।ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদানকারী তুরস্ক, মিশরসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ যদি ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক রেখেও ফিলিস্তিনের পক্ষে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কড়া বিবৃতি দিতে পারে তাহলে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক রেখে বাংলাদেশের পক্ষেও তা করা সম্ভব।ইসরাইল বাংলাদেশের শত্রু নয়, ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে অস্ত্র এবং অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে চাওয়া দেশটি হল ইসরাইল এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সনের ৪ এপ্রিল ইসরাইল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করলেও বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করেন।মুক্তিযুদ্ধের সময় সৌদি আরব, লিবিয়া প্রভৃতি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে, বাংলাদেশকে নয়।যে মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন পাবার জন্য বঙ্গবন্ধু ইসরাইলের সমর্থন নেননি তারা কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।হজ্বে বাধা দেয়ার মতো ধর্ম বিরোধী কাজটি থেকে বিরত রাখতে বঙ্গবন্ধুকে সৌদি বাদশাহের কাছে ছুটে যেতে হয়েছে, কিন্তু সৌদি আরব বাংলাদেশীদের হজ্জ করার সুযোগও দেয়নি।যে ফিলিস্তিনের জন্য মুসলমানেরা একাট্টা সেই ফিলিস্তিনই ইসরাইলের সাথে ইতোমধ্যে সমঝোতা করে ফেলেছে, তাহলে বাংলাদেশ পারবে না কেন? পারবে না, কারণ বাংলাদেশী মুসলমানেরা ‘মিসকিন’ হয়েও মুসলিম উম্মার সাথে রাজনৈতিক আবেগে একাত্ম হওয়ার তীব্র বাসনা পোষণ করে থাকে।

পাকিস্তানের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা মাওলানা মুহাম্মদ খান শেরানি স্পষ্ট করে বলেছেন, কোরআন এবং ইতিহাস অনুযায়ী ইসরাইলিরা এখন যে জায়গা দখল করে আছে তা ইহুদিদের জায়গা, ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়া পাকিস্তানের উচিত হবে।কোন প্রেক্ষিতে তিনি কোরআনের কথা বলেছেন তার ব্যাখ্যা দেননি।কিন্তু জায়গাটি তো ফিলিস্তিনিদেরও।তাই ইসরাইল রাষ্ট্রের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের জন্য স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।শক্তির জোরে ইসরাইল যদি গোয়ার্তুমি করতেই থাকে, ফিলিস্তিনিদের উপর নির্যাতন চালাতেই থাকে, তাহলে ইহুদিদের ঘৃণা করার ধর্মীয় অনুভূতি থামবে না।ইসরাইলের এমন খারাপ আচরণের জন্যই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে এখনো একজন আরেকজনকে ‘তুই ইহুদি’ বলে গালি দিয়ে থাকে।

ইসরাইলের প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর ইতিবাচক পরিবর্তনের হাওয়া বাংলাদেশে লাগেনি।উনপন্চাশ বছর আগে স্বাধীনতা লাভের সময় ইসরাইল ও ফিলিস্তিন সম্পর্কে বাংলাদেশের যে অবস্থান ছিলো এখনো তাই রয়েছে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের কূটনৈতিক চাপ না থাকলে বাংলাদেশের এই অবস্থানে শীঘ্র কোন পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না।কারণ বাংলাদেশের জনগণকে সরকারের পক্ষে শান্ত রাখার জন্য ধর্মীয় আবেগকে প্রশ্রয় দেয়া হয় ব্যাপকভাবে।পাকিস্তান আমলেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্মের এত প্রভাব ছিলো না।সরকার বুঝতে পেরেছে, গোটা মধ্যপ্রাচ্য ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুললেও ফিলিস্তিনিদের অধিকারের ব্যাপারে বাংলাদেশের জনগণ একাট্টা।বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ইসরাইল বিরোধী মনোভাব জোরালো থাকার কারণে ইসরাইল ইস্যুতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল এবং বামপন্থীদের অবস্থান একই বিন্দুতে এসে মিলেছে।

 

লেখক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক

ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের

সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক

ahmedzeauddin0@gmail.com

ahmedzeauddin0@gmail.com

 

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)